ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৯ অগাস্ট ২০২৫ , ৪ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাজশাহীতে ঋণের ফাঁদে প্রাণহানি: সুদের কারবার ও অভাবে নিঃস্ব পরিবার

মাসুদ রানা রাব্বানী
আপডেট সময় : ২০২৫-০৮-১৯ ২১:০৪:১০
রাজশাহীতে ঋণের ফাঁদে প্রাণহানি: সুদের কারবার ও অভাবে নিঃস্ব পরিবার রাজশাহীতে ঋণের ফাঁদে প্রাণহানি: সুদের কারবার ও অভাবে নিঃস্ব পরিবার


মাসুদ রানা রাব্বানী, রাজশাহী: রাজশাহীতে ঋণের অসহনীয় চাপ এবং খাদ্যাভাবের কারণে মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। সম্প্রতি রাজশাহীর মোহনপুরে এক রিকশাচালককে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগে এক সুদ কারবারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। একই কারণে পবা উপজেলায় একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুর ঘটনা গ্রামীণ সমাজে সুদের কারবার এবং এনজিও ঋণের ভয়াবহ প্রভাবের একটি মর্মান্তিক চিত্র দৃশ্যমান হয়েছে। এই ঘটনাগুলো ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার পরিণতি ফুটে ওঠেছে। 


বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে মোহনপুর উপজেলার ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের বেলনা গ্রামে রিকশাচালক ফজলুর রহমানকে (৫৫) হাত-পা বাঁধা এবং গলায় রশি পেঁচানো অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রতিবেশীরা তাঁর মুখ থেকে লালা পড়তে এবং ঘাস পুড়ানো বিষের গন্ধ বের হতে দেখেন। এ ঘটনায় তাকে মোহনপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর অবস্থার অবনতি হলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শুক্রবার (১৫ আগস্ট) রাতে তিনি মারা যান।


ফজলুর মৃত্যুর আগে তাঁর ছেলে শাহ আলমকে (২৫) জানান, স্থানীয় সুদের কারবারি ধুলু মিয়া (৪৫) এবং ৫-৬ জন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি তাঁকে জোর করে বিষ খাইয়েছে। এ ঘটনায় ফজলুরের স্ত্রী আনজুয়ারা বিবি মোহনপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ শনিবার রাতে ধুলুকে করে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করেছে। ফজলুরের চাচাতো ভাই এনামুল হক জানান, ২০২২ সালে ফজলুর ধুলুর কাছ থেকে ৩০হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সুদসহ ৪৩ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও ধুলু আরও ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। গ্রামে সালিশে ১৫ হাজার টাকায় মীমাংসার চেষ্টা হয়, কিন্তু সুদ কারবারি ধুলু তা মানেননি। আনজুয়ারা বিবি বলেন, কোরবানি ঈদের আগে ধুলু এসে হুমকি দিয়েছিল। আমি ৫হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে মানেনি।


ঘাসিগ্রাম ইউনিয়নের ইউপি সদস্য কাওসার সরদার জানান, ফজলুর আলু চাষের জন্য ঋণ নিয়েছিলেন এবং একাধিক এনজিওর ঋণে জর্জরিত ছিলেন, যার কারণে তিনি শহরে রিকশা চালাতেন। মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ আতাউর রহমান বলেন, নিহত ফজলুর একটি ভিডিওতে অভিযুক্তের নাম বলেছেন। ধুলুকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে। একই সময়ে, ১৫ আগস্ট শুক্রবার, পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে মিনারুল ইসলাম (৩৫), তাঁর স্ত্রী মনিরা বেগম (২৮), ছেলে মাহিম (১৪), এবং মেয়ে মিথিলা (৪)-এর মরদেহ তাঁদের বাড়ির দুটি কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়। ওই সময় পুলিশ দুটি চিরকুট উদ্ধার করেন। চিরকুটে ঋণের চাপ এবং খাদ্যাভাবের কথা উল্লেখ ছিল। মিনারুলের পরিবার জানায়, তিনি কৃষি কাজ করতেন, কিন্তু একাধিক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর বাবা রুস্তম আলী জমি বিক্রি করে পাঁচ লাখ টাকার ঋণ শোধ করলেও, মিনারুল আবার ঋণ নিয়েছিলেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ আলী মুর্শেদ বলেন, “মিনারুল চাল কেনার জন্য দুই হাজার টাকা ধার নিয়েছিলেন।


পবা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিয়াউর রহমান জানান, পরিবারটি ঋণ ও অভাবের চাপে ছিল। তদন্ত চলছে। ফজলুরের মৃত্যু তাঁর পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আনজুয়ারা বিবি বলেন, আমার ঘরে  একমুঠো চালও নেই। পাড়া-প্রতিবেশী চাল দিচ্ছে। একইভাবে, মিনারুলের পরিবারের মৃত্যু বামনশিকড় গ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তাঁর মা আনজুরা বেগম বলেন, আমার ঘরে কিছুই থাকল না। স্থানীয়রা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এই পরিবারগুলো এখন কীভাবে বাঁচবে? গ্রামবাসীরা সুদখোরদের অমানবিক আচরণ এবং এনজিওর তাগাদার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এই ঘটনাগুলো গ্রামীণ অর্থনীতির সংকট এবং দরিদ্র মানুষের নিরাপত্তাহীনতার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ঋণের ফাঁদ এবং খাদ্যাভাবের কারণে প্রাণহানি রোধে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।


 

নিউজটি আপডেট করেছেন : Banglar Alo News Admin

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ